আসিয়ান জোটের ১০টি দেশ ছাড়াও এই চুক্তিতে সই করছে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। ভারতের এই চুক্তিতে যোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সস্তা চীনা পণ্যে তাদের বাজার ছেয়ে যাবে এই ভয়ে গতবছর তারা আলোচনা থেকে বেরিয়ে যায়।
রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) নামে নতুন এই জোটের অর্থনীতির আয়তন বিশ্বের মোট জিডিপির ৩০ শতাংশ। ফলে, এই চুক্তি বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবাধ বাণিজ্য এলাকা তৈরি করবে। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা এবং মেক্সিকোর মধ্যে যে মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল রয়েছে সেটি বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও এশিয়ার নতুন এই বাণিজ্য অঞ্চলটির পরিধি বড় হবে।
ব্যবসা বিষয়ক পরামর্শক সংস্থা আইএইচএস মারকিটের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ রাজিব বিশ্বাসকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে. “এই অঞ্চলে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের উদারীকরণে এই চুক্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অগ্রগতি। কারণ, তার মতে, “আরসিইপি বিশ্বের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অঞ্চলে পরিণত হবে।”
২০১২ সালে প্রথম এই চুক্তির প্রস্তাব করা হয়েছিল। তারপর গত আট বছরে ধরে চীনের প্রবল উৎসাহ এবং উদ্যোগে এটি বাস্তবে রূপান্তরিত হচ্ছে। মুক্তবাণিজ্যের এই চুক্তিকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের পথে একটি ক্যু বা অভ্যুত্থান হিসাবে দেখা হচ্ছে বলে তাদের এক মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছে থাইল্যান্ডের অন্যতম শীর্ষ দৈনিক ব্যাংকক পোস্ট।
সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির বাণিজ্যের অধ্যাপক আলেকজান্ডার ক্যাপ্রিকে উদ্ধৃত ব্যাংকক পোস্ট বলেছে, “এই জোট চীনকে তাদের ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ বাস্তবায়নে নিশ্চিতভাবে সাহায্য করবে।”
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে মুক্তবাণিজ্য থেকে আমেরিকা যেভাবে পিছিয়েছে, সেই শূন্যতা দখল করছে চীন। ২০১৬ সালে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১০টি দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র মিলে টিপিপি নামে যে অবাধ বাণিজ্য চুক্তি করেছিল ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটি থেকে আমেরিকাকে বের করে নিয়ে যান। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, নতুন চুক্তিটি হলে ভবিষ্যতে এশিয়ায় বাণিজ্যের নীতি এবং শর্ত নিয়ন্ত্রণ করবে চীন।
গবেষণা সংস্থা কার্নেগী এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ইভান ফেইগেনবমকে উদ্ধৃত করে ওয়াশিংটনের গবেষণা-ভিত্তিক সাময়িকী দি ডিপ্লোম্যাট লিখেছে, “এশিয়ায় প্রধান দুই বাণিজ্য চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র নেই, ফলে এশিয়ায় বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের শর্ত ও মান নির্ধারণের ক্ষমতার হাতবদল হবে, এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে সে মতই ঐ অঞ্চলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলবে।”
দি ডিপ্লোম্যাটের সাবেক সম্পাদক অঙ্কিত পাণ্ডা টুইট করেছেন, “আরসিইপি চুক্তি যে হচ্ছে তাতে ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট যে এশিয়ায় বড় ঘটনা ঘটছে – এবং যুক্তরাষ্ট্র তাতে সামিল হোক বা না হোক আরো এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।”
জাপান এবং অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও চীনা আধিপত্য নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। কিন্তু তা স্বত্বেও আরইসিপিতে যোগ দিতে তারা এখন আর পিছপা তো হচ্ছেই না বরঞ্চ সাম্প্রতিক সময়ে তাদের মধ্যে এ নিয়ে উৎসাহ বাড়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট ।
মালয়েশিয়ার বাণিজ্য মন্ত্রী মোহামেদ আজমিন আলী বলেছেন, “গত আট বছর ধরে রক্ত, ঘাম আর চোখের জল ঝরিয়ে রোববার আরসিইপি সইয়ের জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত প্রস্তুত হয়েছি।”
অনেক বিশ্লেষক বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিণতিতে আসিয়ান জোটের দেশগুলো যে চরম অর্থনৈতিক চাপে পড়েছে, তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এই চুক্তিতে সই করার ব্যাপারে তাদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে। চীন বিশ্বের একমাত্র বড় কোনো দেশ যার অর্থনীতিতে এখনও প্রবৃদ্ধি হচ্ছে।
অল্প কিছুদিন আগে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং ঘোষণা করেছেন, আগামী ১০ বছরে চীন ২২ ট্রিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করবে। তিনি বলেন “চীন এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাজার এবং এই বাজার আরো বড় হবে।” দিনে দিনে তাদের বাজার আরো উন্মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন প্রেসিডেন্ট।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনকে নিয়ে ওজর-আপত্তি-উদ্বেগ থাকলেও, তাদের এই বিশাল বাজারের অংশীদার হওয়ার জন্য এশিয়ার বহু দেশ উদগ্রীব।
আরসিইপিতে এমন কিছু দেশ রয়েছে যাদের কারো কারো মধ্যে মধ্যে বৈরিতা যেভাবে দিন-দিন বাড়ছে তাতে শেষ পর্যন্ত এটি কতটা কার্যকরী হবে তা নিয়ে অনেকের মনেই সন্দেহ রয়েছে। যেমন, চীন ও জাপানের মধ্যে কিছু দ্বীপের মালিকানা নিয়ে বৈরিতা বেড়েই চলেছে। এছাড়া, চীন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে বাণিজ্য নিয়ে রেষারেষির পারদ দিন দিন চড়ছে।
অস্ট্রেলিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ম্যালকম টার্নবুল বলেছেন, আরসিইপি নিয়ে খুব বেশি উৎসাহিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু সিঙ্গাপুরে এশিয়ান ট্রেড সেন্টারের ডেবোরা এমস্ বিবিসিকে বলেন “কাউকে পছন্দ না করলেও তার সাথে সহযোগিতার সম্পর্ক বজায় রাখা খুবই সম্ভব। সাধারণ মানুষও তাদের সম্পর্কে এটি করে। আরসিইপি সেটাই করছে। মতভেদ থাকলেও, বাণিজ্যের সম্পর্ক থেকে সেগুলোকে আলাদা রাখছে।”
এই চুক্তির ফলে আগামী ২০ বছরের মধ্যে জোট এলাকায় মধ্যে একে একে অধিকাংশ আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক উঠে যাবে। টেলিযোগাযোগ, মেধা-সত্ত্ব, ব্যাংক এবং বীমার মত আর্থিক সেবা, ই-কমার্স এবং পেশাদারি সেবার মত স্পর্শকাতর বিষয়গুলোও এই চুক্তির আওতায় থাকছে।
তবে সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ‘রুলস অব অরিজিন’ অর্থাৎ কোন দেশে থেকে পণ্য আসছে তার নতুন সংজ্ঞা নির্ধারিত হবে।
সিঙ্গাপুর থেকে বিবিসির টিম ম্যাকডোনাল্ড বলছেন, রুলস অব অরিজিনের সংজ্ঞায় পরিবর্তনের প্রভাব হবে বিশাল। এই সব সদস্য দেশগুলোর অনেকেরই নিজেদের মধ্যে ইতিমধ্যেই অবাধ বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, কিন্তু তাতে রুলস অব অরিজিন সম্পর্কিত নানারকম বিধিনিষেধ রয়েছে।
এশিয়ান ট্রেড সেন্টারের ডেবোরা এমস্ বলেন, “এখন যে সব মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে তা আরসিইপির তুলনায় অনেক জটিল।”
কোনো সদস্য দেশ যদি তাদের উৎপাদিত পণ্যে ভিন্ন কোনো দেশের কাঁচামাল ব্যবহার করে তাহলে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি থাকলেও তাদের আমদানি শুল্ক গুনতে হয়। যেমন, ইন্দোনেশিয়া যদি তাদের তৈরি কোনো যন্ত্রে অন্য কোনো দেশের আমদানি করা যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে তাহলে আসিয়ান ভুক্ত অন্য দেশে তা রপ্তানিতে শুল্ক দিতে হতে পারে।
তবে আরসিইপি চুক্তিতে সদস্য দেশগুলো থেকে যন্ত্রাংশ কিনলে রপ্তানিতে কোনো সমস্যা হবে না। এই বিষয়টিকেই আসিয়ান জোটের সদস্যদের নতুন এই বাণিজ্য চুক্তিতে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। তবে তার চেয়েও বড় আকর্ষণ চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানির সুযোগ।
সূত্র: বিবিসি